Detail Biography:
লোকনাথ ব্রম্মচারী মুসলমানদের মহাতীর্থ মক্কা শরীফ গিয়েছিলেন পায়ে হেঁটে তাঁর নিজমুখে বলা। মক্কায় যাঁরা ছিলেন, সেই সমস্ত ধার্মিক মুসলমানরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন। আপ্যায়নে পবিত্রতায় আমি মুগ্ধ, আমাকে ওঁরা নিজ হাতে রেঁধে খাওয়ান।
আমি যখন মদিনাতে গমন করি সেখানে এক অসাধারণ সাধক ফকিরের সাক্ষাৎ পায়, নাম আবদুল গফুর। গফুরও যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য (লোকনাথ ব্রম্মচারীর) । পরবর্তীকালে লোকনাথ ঊর্দ্ধপানে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে দেখা দুই শ্রেষ্ঠ ব্রাম্মণ হলেন ত্রৈলঙ্গস্মামী ও আবদুর গফুর।’
‘আমি পাহাড় গিরি-কন্দর ঘুরে ঘুরে বরফে আবৃত থেকে যে সম্পদ আহরণ করেছি, তোরা সেই ধন বসে বসে খাবি।’ - লোকনাথ ব্রম্মচারী।
সাধক মহাপুরুষের দেশ ভারতবর্ষে লোকনাথ ব্রম্মচারী এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। যত দিন যায়, ততই তাঁর মাহাত্ম্যরও প্রভাব যেন বাড়ে। কবেই তিনি তাঁর নশ^র দেহ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু আজও আর্ত ও বিপদাপন্ন মানুষের ডাকে তিনি সাড়া দেন। প্রবল মনঃশক্তিতে তাঁকে স্মরণ করতে পারলে লোকনাথ ব্রম্মচারী অনেকটা যেন প্রত্যক্ষভাবেই ত্রাতারূপে আবিভূর্ত হন। এরকম অনেক নিদর্শন এ কালের মানুষও প্রত্যক্ষ করেছে।
সময় ১১৩৮ খৃষ্ঠাব্দ। চব্বিশ পরগনার বারাসাত মহকুমার অন্তর্গত চাকলা গ্রাম। এই গ্রামের ঈশ্বর তন্ময় ব্রাম্মণ রামকানাই ঘোষালের চতুর্থ সন্তান লোকনাথ। মা কমলাদেবী। অত্যন্ত সুপন্ডিত ও ঈশ্বরে অর্পিত ব্যক্তিত্ব ভগবান গাঙ্গুলীর নিকট লোকনাথের বাল্যশিক্ষা। লোকনাথের প্রিয় বান্ধব ছিলেন বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়। এই দুই বালককে তাঁদের উপবীত গ্রহণের দিনে ভগবান গাঙ্গুলী সঙ্গে নিয়ে কোথায় যে চলে গেলেন, কেউ তা ঠিক যেন টেরও পেল না। লোকনাথের বয়স তখন সবে দশ পেরিয়ে এগারোতে পা দিয়েছে।
বহুস্থান পরিভ্রমণ করে ভগবান গাঙ্গুলী দুই বালককে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন সেকালের জঙ্গলাকীর্ণ কালীঘাটে। সেখানে আরো সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে বালক লোকনাথের পরিচয় হয়, যাঁরা রূপকচ্ছলে তাঁকে নানা উপদেশ দিতেন।
ভগবান গাঙ্গুলী দুই বালককে কঠিন কঠোর ব্রম্মচর্যে অভ্যস্ত করান। লোকনাথ ব্রম্মচারী পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্যদের বলেছেন, ‘গুরুদেব নিজে ভিক্ষান্ন যোগাড় করে আনতেন। আমাদের উপবাস কালে তিনি নিজের হাতে আমাদের শৌচকর্ম করে দিতেন।
পরবর্তীকালে লোকনাথ হিমালয় অঞ্চলে অনেক বছর ধরে ধ্যনমগ্ন থাকেন। যেন এক তড়িৎ-কম্পনের মধ্য দিয়ে তাঁর সিদ্ধিলাভ ঘটে। ওই সময় তাঁর সঙ্গে মহাযোগী হিতলাল মিশ্রের পরিচয় হয়। অনেকের মতে এই হিতলালই হলেন তৈলঙ্গস্বামী।
হিতলালের সঙ্গে তুষারাবৃত হিমালয়ের বহুস্থানে পরিভ্রমণ করেন লোকনাথ ও বেণী মধাব। ওই পরিভ্রমণকালে কোনও কোনও সময়ে তাঁর বাহ্যজ্ঞান থাকত না। বাহ্যচেতনা ফিরে এলে আবার শুরু হত পরিক্রমা।
এক সময় লোকনাথ ব্রম্মচারী পাহাড় থেকে নেমে তিনি পা রাখেন বারদীতে। অল্পদিনেই তাঁর যোগ-বিভূতির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বহু আর্ত মুমূর্যু জন তাঁর স্পর্শে বা আর্শীবাদে সুস্থ ও সাবলীল হয়ে ওঠে। অনেকের জীবন থেকে বিপদের মেঘ কেটে যায়। লোকনাথ নিজমুখে তাঁদের বলেছিলেন, ‘আমি পাহাড় গিরি-কন্দর ঘুরে ঘুরে বরফে আবৃত থেকে যে সম্পদ আহরণ করেছি, তোরা সেই ধন বসে বসে খাবি।’
কিন্তু লোকনাথের সত্তা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন, এমন মানুষের সংখ্যা অতি সামান্য। তিনি বলতেন ‘আমাকে চিনতে পারা সহজ নয়। আমি ধরা দেই, তাই তোরা আমার কিঞ্চিৎ সমাচার পাস মাত্র।’ তখনই তাঁর বয়স দেড়শত বৎসর অতিক্রম করেছে। সুদীর্ঘ সুঠান দেহ। প্রায়শই তাঁকে ঘিরে অনেক অলৌকিক কান্ড ঘটে। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ছিলেন লোকনাথ ব্রম্মচারীর বিশেষ গুণগ্রাহী। তিনি সময় পেলেই ব্রম্মচারী চরণ বন্দনা করতে আসতেন। আবার অতি সাধারণ মানুষ, যাদের নামমাত্র রোজগন্ডা, লোকনাথের প্রত্যক্ষ কৃপালাভে ধন্য হত। অনেক অহঙ্ককারীর তিনি আবার আক্কেলজ্ঞান ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বিস্তর মুসলমান ভক্ত ছিল। এরা দলে দলে বারদীতে আসত তাঁকে দর্শন করতে। একাধিক ইংরেজ রাজপুরুষও তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন।
ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ বারদীর আশ্রমে এসে লোকনাথের পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়েন। তিনি বারদী লোকনাথ ব্রম্মচারীর আশ্রম তৈরীতে বিশেষ অবদান রাখেন।
সাতাশ বছর বারদীর আশ্রমে লোকনাথ ব্রম্মচারী যে সমস্ত অলৌকিক কাজ করেছেন, তার সবিস্তার বর্ণনা দিতে গেলে একখানা বৃহৎ গ্রন্থের রূপ নেবে। সে অবকাশ এখানে নেই, তাই সংক্ষিপ্ত আকারে তাঁকে স্মরণে রাখার জন্য এই আয়োজন।
দেহত্যাগের সময় আসন্ন অনুধাবন করে লোকনাথ ব্রম্মচারী তাঁর কিছু ভক্তকে কাছে ডেকে এনে বসালেন। তাঁর ধবল শীর্ণ দেহটি তখন যেন গাঢ় তুষারে ঢাকা। তিনি বললেন, ‘এ দেহ একটা পাখির খাঁচা, অথচ এই শরীর নিয়েই আমরা কত ব্যস্ত, কত চোখা চোখা কথা বলি . . . . . আমার যে এখনও শরীর একটা রয়েছে, এ কথাটা মাঝে মাঝে স্মরণে থাকে না।’
এইভাবেই প্রচ্ছন্নতার সঙ্গে তিনি তাঁর দেহত্যাগের অভিপ্রায়টি জানালেন।
১২৯৭ খৃষ্ঠাব্দের ১৮ই জ্যৈষ্ঠ (১লা জুন ১৮৯০) লোকনাথ ব্রম্মচারীর মহাপ্রয়াণ ঘটে।